ক্ষমতা নেওয়ার পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দুর্নীতির অভিযোগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শতাধিক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের প্রায় সবার ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল |
এদিকে জুলাই-আগস্ট গণহত্যা নিয়ে বিচার কাজ শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণহত্যার মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এছাড়া পৃথক অভিযোগে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আসাদুজ্জামান খান কামাল আনিসুল হক দীপু মনি আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধেও একই আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। গণহত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র্যাবের তৎকালীন ডিজি আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ যুবলীগ নেতাদের আসামি করা হয়।
২০০৮ সাল থেকে বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল জাতীয় পার্টি (এরশাদ)। দলটি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে অংশ নেয়। দলটি সরকারেরও অংশীদার হয়। পরে ২০১৪. ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে জাতীয় পার্টি। তবে দলটি জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের একটি পর্যায়ে এসে ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নেয়। ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও শুরুতে বহাল তবিয়াতে ছিল দলটির নেতারা। জাপার প্রতিনিধিরা প্রথম দফায় প্রধান উপেদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সংলাপ করে সরকারের প্রতি সমর্থনও ব্যক্ত করে। পরে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী উল্লেখ করে দলটির বিষয়ে ছাত্ররা আপত্তি জানালে পরের সংলাপে তাদের ডাকা হয়নি। এমনকি জাতীয় পার্টি রাজধানীতে বিক্ষোভ- সমাবেশের ডাক দিলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তা প্রতিহত করে। দলটির কার্যালয় পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। সম্প্রতি দলটির কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য গ্রেফতারও হয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের হিড়িক |
শেখ হাসিনার পতনের পর সরকারি আধা-সরকারি স্বায়ত্তশাসিত এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছেড়েছেন আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ অপমান-অপদস্থসহ নানান চাপের মুখে কর্তা ব্যক্তিরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সহ-উপাচার্য প্রক্টরসহ শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা দায়িত্ব ছাড়েন। উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এমপিওভুক্ত স্কুল কলেজেও পদত্যাগের ঘটনা ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের চাপের মুখেও কেউ কেউ পদত্যাগ করেন। অবশ্য কয়েকটি ক্ষেত্রে পদত্যাগ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে।
সরকারের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নির্বাচন কমিশন ও পাবলিক সার্বিক কমিশনের সবাই ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিধিবদ্ধ সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগ করেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যানও। তবে এখনও নির্বাচন কমিশন ও দুদক গঠন হয়নি। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য সরকার সার্চ কমিটি গঠন করেছে। শেখ হাসিনার সরকারের তৃতীয় প্রধান ব্যক্তিত্ব স্পিকার ড. শিরন শারমিন চৌধুরীও এরইমধ্যে পদত্যাগ করেছেন।
বিচার বিভাগ পুনর্গঠন |
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর বিচার বিভাগেও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেছে। গত ১০ আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আপিল বিভাগের অন্য ৫ বিচারপতিও তার সঙ্গে পদত্যাগ করেন। এ ঘটনার পর নতুন বিচারপতি নিযুক্ত হন আপিল বিভাগের বিচারক সৈয়দ রেফাত আহমেদ। একই সময়ে আপিল বিভাগে নতুন আরও চার বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়। অপরদিকে সরকার নতুন করে হাইকোর্ট বিভাগে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে।
সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। সেইসঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে অনেক মামলার রায়। আওয়ামী লীগ শাসনামলে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় দেওয়া ছয় মাসের দণ্ড ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার আগের দিন বাতিল করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অপরদিকে শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। কিন্তু সরকার পতনের একদিন পরেই রাষ্ট্রপতি সাজা মওকুফ করায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মামলাগুলো মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল বলে অভিযোগ করে আসছিল বিএনপি। এর বাইরে মুক্তি দেওয়া হয়েছে কোটা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চলাকালে গ্রেফতার শিক্ষার্থীদের। কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন গত দেড় দশকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার ও কারাবন্দি বিএনপি জামায়াতে ও তাদের সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য নেতা-কর্মী যাদের মধ্যে ২০০৭ সালে যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া গিয়াস উদ্দিন আল মামুনও রয়েছেন। তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানসহ বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার সাজা ইতোমধ্যে মওকুফ হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বেশকিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম ইতোমধ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে। সাভারের শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নাম পরিবর্তনের কার্যক্রম শুরু করে অন্তর্বতীকালীন সরকার। ওই প্রতিষ্ঠানের নাম করা হয় জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। এরইমধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর এর নাম পরিবর্তন করে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের নাম পরির্তন করে গাজীপুর সাফারি পার্ক নামকরণসহ শেখ মুজিব শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এর আগে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামকরণে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে প্রধান করে উপদেষ্টা পরিষদের চার সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জাতীয় আট দিবস বাতিল |
অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের দলীয় দিবস বলে পরিচিত আটটি জাতীয় দিবস বাদ দিয়েছে। দিবসগুলো হলো— ঐতিহাসিক ৭ মার্চ. ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস. ৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী ৮ আগস্ট বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল দিবস ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস ও ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস। এর আগে শোক দিবসের সরকারি ছুটিও বাতিল করে সরকার। এদিকে এ দিবসগুলো বাতিলের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন আওয়ামী লীগের দলীয় দিবসগুলো জাতীয় দিবস হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো জাতীয় দিবস হওয়ার মতো নয়।
ইউপি বাদে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেওয়া হয় |
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের এক সপ্তাহের মাথায় সিটি করপোরেশন পৌরসভা জেলা ও উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করে অন্তর্বর্তী সরকার। পটপরিবর্তনের পর সরকার সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা আত্মগোপনে কিংবা পরিষদে না যাওয়ায় নাগরিক সেবা ব্যাহতের কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। স্থানীয় সরকারের ওই চারটি প্রতিষ্ঠানের পদ থেকে মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হলেও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। যেসব জায়গায় চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত রয়েছেন সেখানে কাজ চালিয়ে নিতে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করতে পরিপত্র জারি করেছে সরকার।
দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা যায়নি |
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সরকারকে নিত্যপণ্যের দাম সংক্রান্ত চাপ সামলাতে হচ্ছে। চাল. তেল. ডিম. পেঁয়াজসহ প্রায় প্রতিটি নিত্যপণের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। মুরগি এবং সবজির দামও বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। এ অবস্থায় আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক কমানো হলেও তাতে বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়েনি। এ সময় সরকার অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা সালেহউদ্দিন আহমেদকে কিছুটা ভারমুক্ত করে নতুন বাণিজ্য উপদেষ্টাও নিয়োগ দিয়েছে। অবশ্য প্রত্যাশিত হারে না হলেও গত দুয়েকদিন হলো সবজিসহ কিছুপণ্যের মূল্য কমেছে।
আটক সাবেক এমপি-মন্ত্রী |
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সাবেক সরকারের এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী সদস্যদের গ্রেফতার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সাবেক সরকারের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা আমলাদেরও গ্রেফতার করা হয়। বিভিন্ন মামলায় ইতোমধ্যেই সালমান এফ রহমান আনিসুল হক কাজী জাফরউল্লাহ ড. আব্দুর রাজ্জাক ফারুক খান শাহাজান খান উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু. আহমদ হোসেন সাধন চন্দ্র মজুমদার, আব্দুস সোবহান গোলাপ আ স ম ফিরোজ জুনাইদ আহমেদ পলক. হাজী মো সেলিম. ড, তৌফিক-ই-ইলাহী. আসাদুজ্জামান নূর. নুরুল ইসলাম সুজন. ফরহাদ হোসেন. নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন রাশেদ খান মেনন. হাসানুল হক ইনু. টিপু মুনশি দীপু মনিসহ বেশ কয়েকজন সাবেক এমপি-মন্ত্রী গ্রেফতার হয়েছেন। এদের অনেকে একাধিক দফায় রিমান্ডের মুখোমুখিও হয়েছেন। জাতীয় পার্টির কয়েকজন সাবেক এমপি-মন্ত্রীও আটক হযেছেন। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সাবেক সচিব জাহাংগীর আলম হেলালুদ্দীন আহমেদ এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান বিচারপরিত শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ অনেকে গ্রফতার হয়েছেন। আদালতে নেওয়ার সময় তাদের অনেকের ওপর হামলাও হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ আগের সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের লাল পাসপোর্ট। আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে যেসব অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল তার সবগুলো বাতিল করা হয়েছে।
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে গত ২৩ অক্টোবর নিষিদ্ধ ঘোষণা করে অন্তর্বর্তী সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে হত্যা নির্যাতন গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য টেন্ডারবাজি ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িতসহ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন. ২০০৯. এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
আওয়ামী লীগের তৎপরতা
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। প্রথম কয়েকদিনে একেবারেই চুপ থাকলেও ১৫ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়ে প্রথমে সামনে আসে ক্ষমতাচ্যুত এ দলটি। ভারতে অবস্থানরত দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ওই সময় শোক দিবস পালন ও ৩২ ধানমন্ডিতে শ্রদ্ধা জানাতে দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন। তবে, ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে তারা সেই কর্মসূচি ঢাকায় সফল করতে পারেনি। অবশ্য ঢাকার বাইরে টু্ঙ্গিপাড়াসহ দেশের কয়েকটি স্থানে দিবসটি পালনের তথ্য পাওয়া যায়। এদিকে মাঠে নিষ্ক্রিয় থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে আওয়ামী লীগের প্রতি অত্যাচার- নির্যাতনের চিত্রসহ বর্তমান সরকারবিরোধী তথ্য নিয়মিত আপলোড করা হচ্ছে। ফেসবুক পেজ থেকে নানা ধরনের বক্তব্য-বিবৃতিও প্রচার করা হচ্ছে। এদিকে প্রথমে নিষ্ক্রিয় থাকলেও ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল বের করছে। অবশ্য বেশিরভাগ থেকে গভীর রাতে ও ভোরবেলায় এই মিছিলগুলো হচ্ছে বলে খবর প্রকাশিত হয়। আওয়ামী লীগ নিজেদের অবস্থান জানান দিতে সর্বশেষ ৯ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। দলের ফেসবুক পেজেই এই কর্মসূচি পালনে সবাইকে জিরো পয়েন্টে জড়ো হতে বলা হয়। দলের প্রধান শেখ হাসিনার একটি কথোপকথনও এ সময় প্রচার হয়। সেখানে তিনি নূর হোসেন দিবস পালনের নির্দেশ দেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান ও ছাত্র-জনতাসজ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী লীগের এ কর্মসূচি পণ্ড হয়। কয়েকটি স্থানে মিছিল বের করতে গিয়ে তারা মারধরের শিকার হয়। অবশ্য ৯ নভেম্বরের পরও রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউসহ কয়েকটি জায়গায় আওয়ামী লীগকে ঝটিকা মিছিল করতে দেখা গেছে।
মব সহিংসতা
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর বাংলাদেশের অনেক স্থানে মব সহিংসতা হয়েছে। অন্তর্বতীকালীন সরকার শপথ নেওয়ার আগের তিনদিন সারা দেশের বেশকিছু স্থানে গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরও সেটা অব্যাহত দেখা যায়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও শালিসকেন্দ্রের প্রতিবেদন মতে আগস্ট থেকে অক্টোবর— এই তিন মাসে দেশে গণপিটুনিতে ৬৮ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় নিহত হয় ২৮ জন। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক মব সহিংসতা প্রসঙ্গে বলেন মব ভায়োলেন্স কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতিটি অপরাধের তদন্ত করতে হবে।
অবশ্য এর আগে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে ‘মব ভায়োলেন্স বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সতর্ক করে দিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেবে এবং বিচার নিশ্চিত করবে সরকার।
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ঘটনার অভি।যোগ ওঠে। কোথাও বাড়িঘরে কোথাও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কোথাও উপাসনালয়ে হামলা-ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। দেশের একটি জাতীয় দৈনিক তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে ৫ আগস্ট থেকে থেকে ১৬ দিনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত ১ হাজার ৬৮টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার সময়ও কয়েকটি স্থানে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামসহ কয়েকটি স্থানে আন্তর্জাতিক শ্রীকৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) কর্মসূচিতে হামলার অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য ইসকনপন্থিদের বিরুদ্ধেও পাল্টা অভিযোগ তুলেছে ইসলামপন্থিরা।
গত অক্টোবরে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ি বাঙালি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৪ জন নিহত হয়। এছাড়া বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
আরও যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে সরকার
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে বেশ কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে— জুলাই ও আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচারে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরকে আমন্ত্রণ শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি সেই সঙ্গে আহত ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ গঠন। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে বড় বড় ঋণখেলাপি ও লুটেরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখল থেকে মুক্ত করে পরিচালনা পরিষদ পুনর্গঠন দুর্নীতি ও অর্থপাচারে অভিযুক্ত প্রভাবশালী দেড়শ ব্যক্তির তালিকা তৈরি ও অনুসন্ধান, ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ অর্থাৎ কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা গণশুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশে নেওয়া প্রকল্প কিংবা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন আছে— এমন প্রকল্প পুনরায় যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) ‘আ নিউ এরা ইন বাংলাদেশ? দ্য ফার্স্ট হানড্রেড ডেজ অব রিফর্ম’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়— ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রশাসনিক নির্বাচন ব্যবস্থা দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুব সহজ নয় বলে উল্লেখ করে ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা আইসিজি। তারা রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি জনগণের প্রত্যাশা ধরে রাখা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক সমর্থন সংহত করা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংস্কারসহ জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে নানা সংস্কার বাস্তবায়নে কিছু সুপারিশ করেছে।
এর আগে সরকারের তিনমাস পূর্তি উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শকিকুল আলম বলেছিলেন মোটাদাগে তিন মাসে সরকার যথেষ্ট অর্জন করেছে। পাঁচটি বড় কাজ হয়েছে। একটি হলো স্মুথ একটি ট্রানজিশন (শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন) হয়েছে। দুই. একটি ভঙ্গুর অবস্থা থেকে অর্থনীতি উদ্ধার হয়েছে। তিন. ব্যাপক বৈশ্বিক সহায়তা পাওয়া গেছে। চার. সংস্কারের পথরেখা দেওয়া হয়েছে। সংস্কারের পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ হবে তখন সংস্কার কতটুকু করা হবে এবং সেটার ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের তারিখ। পাঁচ. এই তিন মাসে বন্যা গার্মেন্টসে অস্থিরতাসহ অনেকগুলো সমস্যা ছিল। সেসব সমস্যা থেকে দেশকে উত্তরণের দিকে নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন আমরা চেষ্টা করেছি এই সমস্যাগুলো কতটা ভালোভাবে মোকাবিলা করা যায়।
Post a Comment